বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন
কক্সবাজার প্রতিনিধি, কালের খবর :
কক্সবাজার আদর্শ মহিলা কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদের কোটিপতি হওয়ার গল্পটি হার মানিয়েছে সিনেমার কাহিনিকে! ছিলেন সামান্য বেতনের শিক্ষক। কিন্তু ‘অধ্যক্ষের পদটি’ নাগালে পাওয়ার পর বদলে গেছে তার জীবনের সব দৃশ্যপট। গত তিন যুগে অধ্যক্ষ ফরিদ হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য। নামে-বেনামে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ, মালিক হয়েছেন বাড়ি ও ফ্ল্যাটের। মাদ্রাসার টাকা আত্মসাৎ সহ অবৈধ উপায়ে গড়ে তোলেছেন পাপের সম্রাজ্য।
গত তিন দশকের বেশি সময়ে ফরিদের মতো আরও অনেক প্রভাবশালী ‘প্রধান শিক্ষক’ অনৈতিকভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো, ফরিদ আহমদ চৌধুরী দলীয় কোনো পদে ছিলেন না কখনো। মহিলা মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষের পদ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজারে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন ফরিদ। এমনই দৌরাত্য ছিল তার; এতিমের টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি রয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানার আবাসিক ছাত্রীদের নিজের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করানোর অভিযোগ।
অভিযোগ উঠেছে, মাদরাসার প্রধান হয়েই নিজের নামে গড়ে তুলেছেন প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ। আর সেই মাদরাসাকে রুপ দিয়েছেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে। আর লুটপাট করেছেন মাদরাসার টাকা ও সম্পদ।
মাদরাসার সম্পদ ১৩টি দোকানের এক কোটি ২০ লাখ টাকা সেলামির এক কানাকড়িও জমা নেই মাদ্রাসা ফান্ডে। সেই সাথে দোকানগুলো হতে প্রাপ্ত প্রতি মাসের ভাড়া বাবদ এক লাখ ২০ হাজার টাকার একটি টাকাও মাদরাসার অ্যাকাউন্টে জমা করেননি। দীর্ঘ ৩৬ বছর একই পদে বহাল থেকে অবসর নেওয়ার পরও মাদরাসাটিতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে নিজের ‘আপন মানুষটিকে’কে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে পদায়ন ও মাদরাসা কম্পাউন্ডের সরকারী একটি ভবন দখল করে বহাল তবিয়তে স্ব-পরিবার নিয়ে বসবাস করে চলেছেন।
ফরিদের অপকর্মের বিশাল মরুভূমিতে পা চালাতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন; অনেকে মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে ফেরারী হয়েছেন; আবার কেউ ঝরিয়েছেন চোখের জল। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত শিক্ষক, তার আপন ছোট ভাই জহির আহমেদ চৌধুরীকে অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সামনে লাটি দিয়ে বদেড়ক পিটানোর অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য দুদকের আশীর্বাদে সেসব হাজারও ভুক্তভোগীর চোখের জলে যেনো দুর্নীতির বিশাল মরুভূমির মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নামে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা মুখ খোলা ছিলো দুঃসাধ্য। সরকারী দলের প্রভাবশালী লোকদের মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে বসিয়ে লুটপাট করেছেন কোটি কোটি টাকা। গত ৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ফরিদ আহমেদ চৌধুরীকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উদ্ধার করে মাদরাসা থেকে বের করে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
কক্সবাজার আদর্শ মহিলা কামিল মাদরাসার সদ্য অবসরে যাওয়া এই অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছাড়াও বর্তমান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন মাদরাসাটির শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদ চৌধুরী প্রতিষ্ঠাকালীন ১৯৮৯ সাল হতে মাদরাসাটির অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন শুরু করে গত ২০২৩ সালের ২ জুন অবসরে যান। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মাদরাসা ক্যাম্পাসে সরকারি ভবনে বসতি গড়ে এখনো অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। অথচ তার পাশেই রয়েছে তার নিজস্ব পরিত্যাক্ত বাড়ি। ফরিদ আহমেদ চৌধুরী মাদরাসা কম্পাউন্ডে থাকা এতিমখানার আবাসিক শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে নিজের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করান।
অভিযোগ সূত্র মতে, মাদরাসা কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকা ছৈয়দিয়া বালিকা এতিমখানার বিদেশি সহায়তার টাকা দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তিনি মাদরাসা ও এতিমখানার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন নিজের ও পরিবারের নামে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ। এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নবনির্মিত ভবনের পূর্বপাশে ঝিলংজা মৌজায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের ১.৮২ একর জমি, রামুর কচ্ছপিয়া মৌজায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের ৭.৪০ একর জমি, ইনানী মৌজায় এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা মূল্যের ২.০৪ একর জমি, কক্সবাজার শহরের বাসটার্মিনাল এলাকায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের আট শতক জমি ও কক্সবাজার পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের ঝিলংজা মৌজার পেতা সওদাগর পাড়ায় ৮ কোটি টাকা মূল্যের ৪০ শতক জমি।
দুদকে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ওই মাদরাসার একটি অংশ ছৈয়দিয়া বালিকা এতিমখানা। এই এতিমখানায় ১০২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও টাকা আÍসাৎ করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নামে-বেনামে ১৭৫ জন শিক্ষার্থীর নাম। অভিযোগ রয়েছে বিদেশি দাতা সংস্থা হতে কখনো তদন্তে এলে মাদরাসার আবাসিক শিক্ষার্থীদের এতিমখানায় নিয়ে গিয়ে এতিম বলে চালিয়ে দিতো।
মাদরাসার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমান উল¬াহ বলেন, “অভিযোগের সবগুলোই সত্য।” তবে তিনি টাকার প্রভাবে এসব অভিযোগ হতে সহজে রেহায় পেয়ে যান। যার ফলে পুনরায় আবারো এসব অপকর্মে লিপ্ত হন।
সাবেক অধ্যক্ষ ফরিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ অতীতেও অনেক করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। তদন্তও হয়েছে বহুবার। তবে মিথ্যা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন জানতে চাই”।